
এই,
বৈঠা বাওয়া বন্ধ করো, সবাই চুপ!’ পানিতে নৌকার বৈঠা ফেলার যে ছলাৎ ছলাৎ
শব্দ, সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। নৌকার আমরা ছয়জনও একেবারে নিশ্চুপ। পাছে শব্দ
হয়, এই ভয়ে পারলে নিঃশ্বাসও বন্ধ করে রাখি যেন। ‘চোখ বন্ধ করুন, কান
পাতুন।’ আশরাফুল কবিরের এ কথার মর্ম বোঝা গেল চোখ বন্ধ করতেই। ছোট্ট দেশি
নৌকা একেবারে গতিহীন নয়, তবে শব্দহীন। কান পেতে শুনতে থাকি নানা রকম পাখির
কিচিরমিচির। কোনটা কোন পাখির ডাক, তা বলতে পারব না—বলার দরকারও নেই।
অপূর্ব নিসর্গে পাখিদের এই আশ্চর্য অর্কেস্ট্রা অনুভব করাই বড় কথা। আশপাশে
আঁকাবাঁকা সব গাছ। মাথার ওপরে ডাল-পাতার ভরাট বুনন। মাঝেমধ্যে নীল-সাদা
আকাশে উঁকিঝুঁকি। পাখির শব্দ শুনি কয়েক মিনিট ধরে। আশরাফুল বলেন, ‘এভাবেই
এই বন উপলব্ধি করা যায়। পাখির শব্দে খোঁজ মেলে বনের আরেক সৌন্দর্য।’

সিলেটের
রাতারগুল বনে আষাঢ়ের এক শেষ বিকেলে আমরা যেন প্রকৃতির অংশ হয়ে যাই।
সকালে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে দুপুরেই পৌঁছেছি সিলেটে। ঘাঁটি
সিলেট-তামাবিল-জাফলং সড়কে খাদিমনগরের নাজিমগড় রিসোর্টে। বাক্স-পেটরা রেখে
সিলেট থেকে রাতারগুল। প্রথম
আলোর সিলেট প্রতিনিধি উজ্জ্বল মেহেদি পথ বাতলে দেন। আলোকচিত্রী আনিস মাহমুদ আর দেশটিভি ও ইংরেজি দৈনিক দ্য
ইন্ডিপেন্ডন্ট-এর
স্থানীয় আলোকচিত্রী আশরাফুল কবির আমাদের সঙ্গী। আশরাফুল হচ্ছেন
রাতারগুলপ্রেমিক। এই জায়গা তাঁর কাছে সুন্দরতম স্থান। এখানে গিয়ে কেউ
কোলাহল করলে, কেউ চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল ফেললে আশরাফুল ব্যথিত হন।
রাতারগুলে গিয়েও সে কথা বোঝা যায়। এটি মূলত জলার বন (সোয়াম্প ফরেস্ট)।
বর্ষাকালে এতে পানি থাকে আর শীতকালে এটি শুষ্ক। মাত্র পাঁচ একর জায়গাজুড়ে
এ বন। তাই আশঙ্কা, বনটা টিকবে তো?
রাতারগুলে হিজল, করচ, বনজাম, জংলী বট—এসব গাছ একটার সঙ্গে আরেকটা
মিলেমিশে তৈরি করেছে অন্য রকম এক প্রকৃতি। আছে মুতরা নামের গুল্মজাতীয়
উদ্ভিদ। আনিস জানান, মুতরা থেকেই তৈরি হয় শীতলপাটি। ‘

আর
শীতকালে এই বনের মধ্য দিয়ে হাঁটা যায়। মাটিতে তখন যেন বিছানো থাকে ঝরা
পাতার কার্পেট।’ সিলেট শহর থেকে কোম্পানিগঞ্জের রাস্তা ধরে ধুপাগুল, তারপর
কাঁচা-পাকা পথ দিয়ে মোটর ঘাট। মোট ৩০ কিলোমিটার। এখানে ছোট নৌকা নিয়ে
১০-১২ মিনিটেই ঢোকা যায় রাতারগুল বনে। বর্ষাকালে বনে ৮-১০ ফুটের মতো পানি
থাকে। তার ওপর গাছের চাঁদোয়া। এ বনে সাপ আছে, আছে বানরও। বলতে বলতেই এক
গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে গেল একদল বানর। বন থেকে বেরোতে ইচ্ছে হয় না।
তবে সন্ধ্যা নামছে দ্রুত, তাই আবার ফিরে চলা। আগের রাতেই ঠিক হয়েছিল প্রথম
আলোর
শাবিপ্রবি প্রতিনিধি মিসবাহ্ উদ্দিন আমাদের নিয়ে যাবেন লালাখাল আর জাফলং।
পরদিন সকাল ১০টার দিকে রওনা লালাখালের দিকে। সিলেট-জাফলং সড়কের মাঝখানে
আইল্যান্ডের মতো আছে জৈন্তা রানির বিশ্রামাগার। এর ডান দিক দিয়ে লালাখালের
রাস্তা। প্রায় আধঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম লালাখালের মুখে।

এখান
থেকে ইঞ্জিনচালিত এক নৌকায় শুরু হলো লালাখাল দর্শন। দুই দিকেই পাহাড়,
টিলা। একদিকে চা-বাগান। সময় থাকলে নৌকা থামিয়ে চা-বাগান দর্শনও করা যায়।
টিলার ওপরে ওয়াচ টাওয়ারের মতো দাঁড়িয়ে আছে নাজিমগড়ের আরেকটি
রিসোর্টের স্থাপনা। খালের একটা দিক বাংলাদেশে, আরেকটা ভারতে। কিছুদূর যেতেই
খালের পাশের টিলায় বিএসএফ ক্যাম্প। মাঝি হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে চিৎকার করে
আরেকটু এগোনোর অনুমতি নিয়ে নিল। নৌকা কিছুটা এগোতে চোখে পড়ল বিরাট এক
টিলার ওপর লম্বা লম্বা গাছের সারি। সুপারির বাগান, পড়েছে ভারত সীমানায়।
নানা উচ্চতায় টিলার পুরোটাতেই হাজার হাজার সুপারি গাছের সারি। একটার মাথা
যেখানে শেষ হয়েছে, আরেকটা সুপারিগাছের গোড়া সেখানে শুরু হয়েছে।
সুপারিগাছের এমন বিন্যাস সহসা দেখা যায় না। দুপুরে আমরা পৌঁছালাম জাফলং।
তামাবিল-জাফলং সড়কের পাশে ভারতীয় পাহাড়-টিলা। পাহাড়ের সবুজ ভেদ করে
শুভ্র রেখা দেখা যায় মাঝেমধ্যে। এগুলো ঝরনা। পাশাপাশি ওপরে-নিচে বেশ
কয়েকটা। বর্ষায় ঝরনার সেই জল ঝরে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। জাফলং, প্রকৃতি
আর যান্ত্রিকতার বৈপরীত্য যেন এখানে। স্বচ্ছ জলে ভেসে আসে পাথর। নদী থেকে
পাথর তুলে নৌকা দিয়ে আনা হয় পাড়ে। শত শত ট্রাকে পাথর তোলা হয়। আর
এখানে-সেখানে পাথর ভাঙার যন্ত্র, জান্তব তার আওয়াজ। তবুও নদী নিয়ে ওপারে
খাসিয়াপল্লি গেলে আবার অন্য রকম অনুভূতি হয়।
জাফলংয়ের নদীর ওপাশেই ভারতের ডাউকি এলাকা। পাহাড়ের গায়ে লোকালয়।
সাদা, হলুদ, নীল ও সবুজ দালান, টিনের চাল। ভারতের মধ্যেই পড়েছে জাফলংয়ের
তোলা ছবির সেই বিখ্যাত পটভূমি ঝুলন্ত সেতু। স্বচ্ছ জলের স্রোতে নৌকা
থামিয়ে অপেক্ষা করি সেতুর কাছে গিয়ে। মিনিট কয়েক পর সেতুতে ওঠে একটা
গাড়ি। মনে মনে ভাবি, সেতু পেরিয়ে উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা পথ ধরে এ গাড়ি
নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে শেষের
কবিতার শিলং শহরে।
যেভাবে যাবেন

সড়ক,
রেল ও বিমানপথে সিলেট যাওয়া যায়। রাতারগুল যেতে সিলেট থেকে বাস, টেম্পো
বা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ধুপাগুল, সেখান থেকে রিকশা বা অটোরিকশায় মোটর
ঘাট। ভাড়া গাড়ি নিয়ে লালাখাল ও জাফলং ঘুরে আসা যাবে দিনেও। আবার এ পথে
বাসেও যাওয়া যায়। থাকার জন্য নানা মানের নানা ভাড়ার হোটেল ও রিসোর্ট আছে
সিলেট শহর ও এর আশেপাশে।
No comments:
Post a Comment